• সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২০ পূর্বাহ্ন

স্মার্ট দেশের স্বপ্ন ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তর

ড. এম তারিক আহসান / ১১৫ বার দেখা
আপডেট : মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

হাজার বছরের বৈশ্বিক ইতিহাসে শিক্ষাধারার বড় বড় রূপান্তরের প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় যুগে যুগে। এসব রূপান্তরের পেছনে কাজ করেছে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব। কখনো এ রূপান্তর ঘটেছে পুরো পৃথিবীতে, কখনো হয়তো কোনো নির্দিষ্ট ভূখন্ডে। বর্তমান বিশ্ব শিক্ষাধারার একটি বড় রূপান্তরের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা রূপান্তর কার্যক্রম বৈশ্বিক পরিবর্তনেরই অংশ। বৈশ্বিক পরিবর্তনের আলোকে বাংলাদেশের শিক্ষায় রূপান্তরকে নিজেদের মতো করে বাস্তবে রূপ দিতে হলে চাই অতীতকে ফিরে দেখা, বর্তমানকে উপলব্ধি করা এবং ভবিষ্যৎকে অনুধাবন করা। বাংলাদেশ যে স্বপ্ন ছোঁয়ার আকাক্সক্ষা ধারণ করেছে, তা বাস্তবে রূপ দিতে শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরের এখনই সঠিক সময়! কারণ ২০২৩-এ যে শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলো, সে হবে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশে ২৪ বছরের স্মার্ট নাগরিক।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা রূপান্তর কার্যক্রম নিজেদের মতো করে সাজানোর প্রয়োজনে প্রথমেই শিকড়ের অনুসন্ধান করে দেখা যাক। বাংলায় মানব বসবাসের ইতিহাস হাজার বছরের। প্রাচীন বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো গড়ে উঠে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর ভিত্তি করে। তবে সেই শিক্ষা কাঠামো শুধু ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়নি। প্রাচীন বাংলার মানুষ পরিচালিত শিক্ষা কাঠামোতে পরাবিদ্যা/অধ্যাত্মবাদ ও অপরাবিদ্যা/পার্থিব বৈষয়িক শিক্ষা প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে সম্রাট অশোকের সময়ে এসে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসারের সময় বাংলার স্তরভিত্তিক গণশিক্ষা কাঠামো গড়ে ওঠার প্রমাণ মেলে যেখানে প্রাথমিক (০-১৬ বছর) ও পঞ্চবিদ্যার (১৬ বছরের ওপরের শিক্ষার্থী) প্রসার ঘটে। পরে সেন আমল, মুসলিম সুলতানি ও মুঘল আমলে শিক্ষায় যুগের চাহিদা পূরণে নতুন নতুন বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি এবং ধীরে ধীরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার স্তরবিন্যাস করা। প্রাচীন বাংলার শিক্ষার কাঠামো হিসেবে টোল, গুরুগৃহ, পাঠশালা, গুরুকুল, মক্তব, মাদ্রাসার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছিল এলাকাভিত্তিক। ছিল না কোনো বয়সের বাধা, সময়ের বাধা কিংবা সুনির্দিষ্ট শিক্ষাক্রম। শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থী মিলে শিক্ষাক্রম নির্ধারণ করতেন, তা হতো এলাকার চাহিদাভিত্তিক ও কর্মমুখী এবং এলাকার মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো। সুখময় সেনগুপ্ত তার বঙ্গদেশীয় ইংরেজি শিক্ষা বইয়ে বাংলায় ধর্ম প্রচারক উইলিয়াম ওয়ার্ডের (১৮০৩) রিপোর্ট অনুযায়ী বলেন, ‘বাংলার সব গ্রামেই সাধারণ বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।’ প্রাচীন বাংলার শিক্ষা কাঠামো এবং তার রূপান্তর প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ কাঠামো অনেক নমনীয়, জীবনমুখী, প্রয়োগমুখী, এলাকাভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনধর্মী ছিল। এরকম একটি শিক্ষা কাঠামো বাংলার মানুষের উন্নয়নে কেমন ভূমিকা রাখতে পেরেছে? বাংলার শিক্ষা মডেল বিশ্বকে ব্রহ্মগুপ্ত, আর্যভট্টর মতো গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ উপহার দিয়েছে। এই শিক্ষা মডেল যেহেতু এলাকাভিত্তিক এবং জীবনমুখী ছিল তাই বাংলার মানুষ সামাজিক মূল্যবোধ চর্চার পাশাপাশি মসলিন, কটন, ই¯পাত, কৃষিপণ্য, অলংকার, লবণ ইত্যাদি রপ্তানি করত এবং এ কারণে বাংলার সঙ্গে বৈশ্বিক যোগাযোগ ছিল প্রাচীনকাল থেকে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, প্রাচীন ভারতের কর্মকা- বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখত, যার অর্ধেক আসত বাংলা থেকে। কাজেই প্রাচীন বাংলার শিক্ষা কাঠামো বাংলাকে একটি সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশ দুইশ বছর শাসন করে যখন বাংলা ছেড়ে যায় তখন বাংলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৈশ্বিক বিবেচনায় মাত্র ৩ শতাংশে নেমে আসে।

ব্রিটিশ উপনিবেশ বাংলাকে দুইশ বছর শাসন করার মতো পরিবেশ তৈরি করার জন্য শুরুতেই শিক্ষা কাঠামোতে রূপান্তরের কাজে হাত দেয়। বাংলার সমৃদ্ধ শিক্ষা কাঠামো ভেঙে ব্রিটিশ কলোনিয়াল পাবলিক এডুকেশন মডেল স্থাপনের উদ্দেশ্যে অ্যাডাম রিপোর্ট (১৮৩৫); উড এডুকেশন ডেসপাচ (১৮৫৪) এবং হান্টার কমিশন রিপোর্ট (১৮৬২) প্রভৃতির মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার শিক্ষা কাঠামোর নমনীয়তা, এলাকাভিত্তিক মডেল এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনানুষ্ঠানিক স¤পর্ক নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়। শিল্প বিপ্লবের সময়কালীন ব্রিটিশ সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরি এবং ঔপনিবেশিক আমলের অনুগত মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে এমন একটি জনগোষ্ঠী প্রয়োজন ছিল যারা তাদের এলাকাভিত্তিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভুলে যাবে, প্রশ্ন করবে না, বিতর্ক করবে না, যুক্তি দেবে না, নিজের মত প্রকাশ করবে না। কাজেই তারা সেই লক্ষ্য সামনে নিয়েই একটি নিয়মে আবদ্ধ, কেন্দ্রপরিচালিত, বইনির্ভর, মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাভিত্তিক, নম্বরভিত্তিক একটি শিক্ষাব্যবস্থা দেশব্যাপী চালু করল। ব্রিটিশ শিক্ষা রূপান্তর ছিল বাঙালি জাতিসত্তার ওপর বড় ঔপনিবেশিক আঘাত। বিগত কয়েক শতকে উন্নয়নশীল দেশগুলো শিল্পবিপ্লবের সময় ও ঔপনিবেশিক শিক্ষা মডেলই অনুসরণ করে এসেছে, মূলত শ্রমবাজারকে সামনে রেখে, শ্রমিক ও ভোক্তা হিসেবে মানুষকে তৈরি করাই ছিল যার মূল উদ্দেশ্য।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনে পূর্ব বাংলার শিক্ষা কাঠামোর রূপান্তর প্রচেষ্টা ছিল বাঙালি জাতিসত্তার ওপর নব্য ঔপনিবেশিক আঘাত। এ রূপান্তরে মূল আদল অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শিক্ষা মডেল ঠিক রেখেই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এ ভূখন্ডের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য দুর্বল করে দিয়ে এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারকে সংকুচিত করে একটি পশ্চাৎপদ ও অধীন জাতিগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা। বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হওয়ার শুরু থেকেই পূর্ব বাংলা নাম প্রস্তাবের মাধ্যমে এ ভূখন্ডের মানুষের পরিচিতি ও অধিকারের দাবি নিয়ে সোচ্চার হন। পরে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পশ্চিম পাকিস্তানের কূটকৌশল আরও ¯পষ্ট করে। এ জাতিকে শিক্ষাবিমুখ করা এবং বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে যাতে গড়ে না ওঠে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৫৮ সালে শরিফ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, যার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও কলা ইত্যাদি বিভাগ বিভাজনের সূচনা হয়। এরপর থেকেই বিজ্ঞান শিক্ষায় শহর-গ্রাম বৈষম্য, জেন্ডার বৈষম্য এবং তথাকথিত মেধাবী-অমেধাবী বৈষম্যর সূচনা হয়। এর ফলে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি ছিল একমুখী শিক্ষাধারা ফেরত আনা।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার পরই তিনি প্রথমেই যে কাজটিতে মনোনিবেশ করেন সেটি হলো শিক্ষা রূপান্তর। ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭৪) রিপোর্টের মাধ্যমে পুনরায় বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে একমুখী শিক্ষা প্রবর্তন করে একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতি তৈরি করা, মুখস্থনির্ভর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ার বদলে অংশগ্রহণমূলক, অনুসন্ধানী শিখনের মাধ্যমে সৃজনশীল জাতি তৈরি, শহর-গ্রামের বৈষম্য দূর করার জন্য প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ, উচ্চশিক্ষায় মুখস্থনির্ভরতা ও সার্টিফিকেটমুখী কমিয়ে গবেষণার পরিবেশ তৈরির জন্য ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স জারি করে মুক্তবুদ্ধি ও সৃজনশীলতার চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা রূপান্তর প্রক্রিয়া আর আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৭৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে বেশ কিছু শিক্ষা কমিশন এবং শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণীত হয়। এগুলোর মাধ্যমে শিক্ষায় ছোট ছোট সংস্কার করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু শিক্ষায় রূপান্তরের মতো কোনো প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি। মূলত ঔপনিবেশিক শিক্ষা মডেলকে ঠিক রেখেই শিক্ষার্থীদের গভীর চিন্তন প্রক্রিয়ার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য বহুনির্বাচনী প্রশ্ন, কাঠামোবদ্ধ সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করা হয়, কিংবা স্বল্প নম্বরের বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করে মুখস্থনির্ভর লিখিত পরীক্ষার বিধান চালু করা হয়। যার ফলে প্রায় দুইশ বছর আগের ঔপনিবেশিক আমলে প্রতিষ্ঠিত সেই নিয়মে আবদ্ধ, কেন্দ্রপরিচালিত, বইনির্ভর, মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাভিত্তিক, নম্বরভিত্তিক শিক্ষাব্যাবস্থারও কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি।

বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শিক্ষা মডেলকে পরিচালনা করে গুণগতভাবে আমরা আসলে কী অর্জন করছি? সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন (২০২২) রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ বেশি ভাষা ও যোগাযোগ যোগ্যতা এবং দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গাণিতিক যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির গড্ডালিকা প্রবাহের মধ্যে দিন শেষে আমাদের সন্তানরা কী অর্জন করছে? ব্যানবেইস (২০২২)-এর গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭১ শতাংশ অর্থাৎ প্রাথমিকে ১৪ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৩৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও উচ্চমাধ্যমিক ২১ দশমিক ১৪ শতাংশ পর্যায়ে ঝরে পড়ে। গণসাক্ষরতা অভিযানের (২০১৪) গবেষণা বলছে, এ মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হওয়া সত্ত্বেও অভিভাবকদের কোচিং, গাইডবই এবং প্রাইভেট টিউশনির জন্য বিপুল শিক্ষাব্যয় বহন করতে হচ্ছে। শিক্ষাক্রমের নমনীয়তার অভাবে কভিড-১৯ অতিমারীর সময় পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশে দীর্ঘদিন শ্রেণিকার্যক্রম বন্ধ ছিল এবং শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন রেকর্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না থাকায় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করতেই হিমশিম খেয়েছি। দেশে মোট সার্টিফিকেটধারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৮২ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কর্মহীন থাকছে প্রায় আট লাখ তরুণ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন এ তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ভর্তি এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পরও এই সনদসর্বস্ব মুখস্থনির্ভর শিক্ষা মডেল দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম মানুষ তৈরি করতে যেমন পারছে না, তেমনি সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরির মাধ্যমে জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনেও ব্যর্থ হচ্ছে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ‘শ্রমভিত্তিক মডেল’ অবলম্বন করে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে, তা অচিরেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে নতুন অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। যার কারণে বর্তমানের অনেক পেশা অচিরেই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। বৈশ্বিক রূপান্তরের ধারায় পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি দেশ শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাচ্ছে। আমরা এমন একটি যুগে প্রবেশ করেছি যখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শিক্ষায় ভর্তি-শিখন প্রক্রিয়া-মূল্যায়ন, চাকরি প্রাপ্তির বিধি, পেশার ধরন, উৎপাদনক্ষম মানুষের বৈশিষ্ট্য সব পাল্টে যাচ্ছে। ২০৪১ সাল নাগাদ স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়া স্বপ্ন ছোঁয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে বাংলাদেশও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায়ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, বর্তমান পৃথিবীতে লেখাপড়া আর কনটেন্ট মুখস্থ করা নয়, কাজেই শিখন উপকরণ শুধু পাঠ্যবই নয়। এর সঙ্গে গতানুগতিক মুখস্থনির্ভর পেপার-পেনসিলভিত্তিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার চর্চা কমিয়ে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা পরিমাপের উদ্দেশ্যে মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর চাহিদা পূরণে ভবিষ্যতের শিক্ষা রূপান্তর শিক্ষার্থীর পাঁচটি ক্ষেত্রে নমনীয় শিক্ষাক্রম নিশ্চিত করতে চায়। এগুলো হলো কী শিখবে? কেন শিখবে? কোথায় বসে শিখবে? কীভাবে শিখবে? এবং কখন শিখবে? এই নমনীয়তা ব্যক্তিনির্ভর-স্বপ্রণোদিত শিখন মডেল (Personalized-self regulated Learning Model) হিসেবে নামকরণ করা হয়, যা ভবিষ্যৎ শিখন কৌশল হিসেবে সমাদৃত। একটু অতীত অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, আমাদের প্রাচীন বাংলার এলাকাভিত্তিক মডেলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবার উপরোক্ত পাঁচটি ক্ষেত্রে যথেষ্ট নমনীয়তা ছিল। অথচ বাংলার সেই অতীত শিক্ষা মডেলের বৈশিষ্ট্য আজ আমাদের স্মৃতিতেও নেই। কাজেই বাংলাদেশে এবারের শিক্ষায় রূপান্তর একদিকে যেমন বাঙালি জাতিসত্তার শিকড়ের অনুসন্ধান, অন্যদিকে অতীতের শিক্ষা মডেলের সঙ্গে ডিজিটাল প্রযুক্তির সম্মিলন ঘটিয়ে এ রূপান্তরের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন ছোঁয়ার আকাক্সক্ষা ধারণ করে। আসুন আমরা সবাই মিলে সেই স্বপ্ন পূরণে ব্রতী হই।

 

লেখক : অধ্যাপক, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সদস্য, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটি,

এনসিটিবি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ