• সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা এবং কিছু কথা

বাসার তাসাউফ / ১০১ বার দেখা
আপডেট : শনিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৪

কাজী কাদের নেওয়াজ উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা দিয়ে উচ্চরবে যে বলেছিলেন ‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির।’

শিক্ষাগুরুর সেই শির এখন ক্রিকেট স্ট্যাম্পের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে অস্মান ও মর্যাদাহীনতায়। আর এখন শিক্ষককে পদচ্যুত করে ছাত্র বসে গেছে শিক্ষকের চেয়ারে।

আসলে মর্যাদা কিংবা সম্মানের বিষয়টি আপেক্ষিক। শিক্ষকের মর্যাদা বিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম হয়ে থাকে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। ব্রিটেনের এক গবেষণা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল রিসার্চ’ এর এক গবেষণা অনুযায়ী, চীনে ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থীই মনে করে, শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। এর ফলে চীনের শিক্ষকরা অন্য যেকোনো পেশাজীবীর চেয়ে বেশি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিতও হয়। তবে বিশ্বের এমন অনেক দেশও আছে, যেখানে শিক্ষকদেরকে ন্য‚নতম সম্মানটুকুও দেওয়া হয় না। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের সম্মানের মানসিকতা পোষণ করে মাত্র ৩৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর বাংলাদেশে বোধহয় তার চেয়ে কম। যুগের বিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে এ দেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষার ধরন বদল হলেও শিক্ষার্থীদের মানসিকতারও বদল হয়েছে।

ক্লাসে পড়া বলতে না পারলে কান ধরে উঠা ও বসা কিংবা এক পা তুলে দুই হাতে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা কাছে ডেকে নিয়ে চোখ রাঙা করে হাত পাতিয়ে জালি বেত দিয়ে চপাক চপাক আঘাত করাÑ এসব ছিল আমাদের শৈশবের বিদ্যালয়ে মামুলি ঘটনা। আমরা স্যার কিংবা ম্যামদেরকে বাঘের মতো ভয় পেতাম।

প্রাথমিকে পড়ার সময় সহপাঠীর সাথে ঝগড়া করার অপরাধে মান্নান স্যার একবার বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আমাকে এমনভাবে মেরেছিলেন যে, শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুলে-ফেপে রক্ত ঝরেছিল অঝোরে। বাড়ি এসে আব্বার কাছে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম, আব্বা আমার হয়ে স্যারকে বকে দিবেন। আব্বা পরদিন আমাকে নিয়ে স্যারের কাছে গিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু তিনি স্যারকে যে কথাগুলো বলেছিলেন তা শুনে আমি তো রীতিমতো হতবাক! আব্বা বলেছিলেন, ‘মাস্টার সাব, পোলারে মানুষ করতে গিয়া যদি এর চাইতেও কঠিন শাস্তি দেওন লাগে দিবেন, আমার কোনো আপত্তি নাই। পোলার শরীলে আড্ডিগুলা থাকলেই অইব।’
আব্বার বলা কথাগুলো আজও ভুলিনি। যদিও এরপর মান্নান স্যারের হাতে আমি আর কখনো মার খাইনি।

জানি না, আব্বার কাঙ্খিত মানুষ হতে পেরেছি কি না। প্রাথমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ-ভার্সিটি পেরিয়ে আজ আমিও একজন মাস্টার। জীবনে কখনো আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরুদের সাথে কিঞ্চিত বেয়াদবি করেছি কিনা মনে পড়ে না। এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান্নান স্যারের সাথে দেখা হলে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে সালাম ও কুশল বিনিময় করি। এখনও চলার পথে হাই স্কুলের কোনো টিচারের সাথে দেখা হলে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার শ্রদ্ধেয় টিচার অতিক্রম করে গেলে তাঁর পেছনে হেঁটে আমি পথ চলি। কলেজের রেজাউল স্যার, হুমায়ূন স্যার, শিপন স্যার, নাজমুল স্যার ও হাবিব স্যারের সাথে প্রায়ই দেখা হয়। সিএনজিতে থাকলে স্যারকে পেছনের সিট ছেড়ে দিই। রিক্শায় থাকলে নেমে যাই। স্যারকে সালাম দিয়ে তারপর আমার রিকশায় চড়ি।

এভাবে আমার সব শিক্ষাগুরুকে যথাযথ সম্মান দিতে চেষ্টা করি। আর এ সবকিছু শিক্ষা দিয়েছেন প্রথমে আমার আব্বা-আম্মা, পরে আমার শিক্ষকেরা। আমি মনে করি, একজন ছেলে কিংবা মেয়ে মানুষ হওয়ার প্রথম শিক্ষাটা পেয়ে থাকে পরিবার থেকে। পরিবারের শিক্ষাটাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তরান্বিত করে শিক্ষকেরা। আমাদের কালের শিক্ষকেরা বেতের আঘাত দিয়ে কিংবা অন্য যেকোন শাস্তি দিয়ে হলেও আমাদের মানুষ করে গড়ে তুলতে পেরেছেন। আর এ কালে শিক্ষকদের হাত থেকে বেত কেড়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প তুলে দেওয়া হয়েছে। যার পরিণতিতে সাভারের আশুলিয়া কলেজ শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের মৃত্যু হয়েছে।

বাসার তাসাউফ
কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাকণ্ঠ

 

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ